
অনলাইন ডেস্ক
নানা অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে বরিশাল সদর ভূমি অফিসে সার্ভেয়ার পদে কর্মরত রিয়াজ উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এক ভুক্তভোগী বিচার চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন। আর তদন্ত অনুযায়ী দোষী প্রমাণিত হলে শাস্তির মুখোমুখীও হতে হবে রিয়াজকে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
এদিকে রিয়াজের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় রামনগর ইউনিয়নের এক ছাত্রলীগ নেতা বশিরকে শেল্টারদাতা হিসেবেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে মুরাদুল ইসলাম নামের এক অষ্ট্রিয়া প্রবাসী। সম্পর্কে বশির তার শ্যালিকাকে বিয়ে করেছে।
ভুক্তভোগী মুরাদুল অভিযোগে জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে বাউফলের রামনগর এলাকার ছাত্রলীগ নেতা বশিরের সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে সরলতার সুযোগ নিয়ে বশির আমার কাছ থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ আত্নসাত করেছে। তার ইউনিয়নের বিলাসবহুল বাড়িও আমার প্রেরিত অর্থ দিয়ে তৈরি করা। এছাড়া কয়েকটি বিলাসবহুল মোটরসাইকেল ও ব্র্যান্ডের মোবাইলও আত্নসাত করেছে বশির। এভাবেই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আমার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কের সুত্র ধরে আমার পাঠানো প্রায় দুই কোটি টাকা আত্নসাত করেছে বশির। সর্বশেস কুয়াকাটায় আমার নামে জমি ক্রয়ের নাম করে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বশির। যদিও জমিতো দুরের কথা টাকাও পরবর্তীতে ফেরত দেয়নি এই প্রতারক ।
মুরাদুল অভিযোগে আরও জানান, আমার পাঠানো অর্থ দিয়ে বশির আমার সাথে একদিকে বন্ধুত্ব রেখে অন্যদিকে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে । যার ফলস্বরুপ সার্ভেয়ার রিয়াজের ছোট শ্যালিকা রানুকে গোপনে বিয়ে করে। যদিও পুরো বিষয়টি রিয়াজ জেনেও তাদেরকে শেল্টার দেয়। এছাড়া আমি রিয়াজের সাথে কথা বললেও তিনি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে বিভিন্নভাবে হুমকি প্রদর্শন করেন। এছাড়া তার বাসায়ও বশির , রানুকে নিয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করে। যার ডকুমেন্ট আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
তিনি আরও জানান, প্রতারক বশির জমি ক্রয়ের নাম করে অর্থ আত্নসাতের ঘটনায় আমার বড় ভাই সাইদুল ইসলাম সায়েম বরিশালের বিজ্ঞ আদালতে মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলায় বরিশাল মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি) কে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা পেয়ে সে অনুযায়ী প্রতিবেদন দাখিল করলে বিজ্ঞ আদালত বশিরের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। কিন্ত প্রতারক বশির সেখানেও তার অসাধু অপকৌশলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সার্ভেয়ার রিয়াজকে।
মুরাদুল অভিযোগে জানান, আমার বরিশালের এলাকায় এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করা জমি পুনরায় আমরা ক্রয় করলে সেই জমির কাগজপত্র বিজ্ঞ আদালতে পেশ করে আমার সাথে সমঝোতা হয়েছে এমন ভুয়া তথ্য প্রেরণ করে জামিন লাভ করে প্রতারক বশির । আর এতে সহায়তা করে সার্ভেয়ার রিয়াজ বলে অভিযোগে জানান মুরাদুল।
তিনি বলেন, দীর্ঘবছর ধরে সম্পর্কের সুত্র ধরে বিপুল অর্থ আত্নসাতের ঘটনায় বশির ও তার পুরো পরিবার যুক্ত ছিল। আমি প্রতারণা ধরে ফেলায় ঐসময়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ও বিভিন্ন পর্যায়ের সন্ত্রাসী লোকদের দিয়ে আমাকে হুমকি-ধামকিও দিয়েছে। সর্বশেস সার্ভেয়ার রিয়াজ প্রতারক বশিরের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এ-বিষয়ে আমি প্রতারক বশিরের গ্রেপ্তারসহ রিয়াজেরও বিচারের দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
এদিকে এই অসাধু সার্ভেয়ার রিয়াজের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলেও রহস্যময় কারনে থেকে যান ধরাছোয়ার বাহিরে। অনেকে রিয়াজের দ্বারা ভুক্তভোগীর শিকার হলেও অজানা আতঙ্কে মুখ খুলছিলেন না। তবে হঠাৎই বরিশাল সদর ভূমি অফিসের অনিয়ম-ঘুষ বাণিজ্যের হোতা রিয়াজের গোমর ফাঁস হতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অনেক ভুক্তভোগী সার্ভেয়ার রিয়াজ কর্তৃক প্রতারণার শিকার হয়ে তাদের অসহায়ত্বের কথাও তুলে ধরেন। আর এরই মাঝে এক ভুক্তভোগী সার্ভেয়ার রিয়াজের বিরুদ্ধে অনিয়ম-ঘুষবাণিজ্য ও অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে মাঠ পর্যায়ে তদন্তকালে মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশের বিচার চেয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানাগেছে, বরিশাল নগরীর ১০নং ওয়ার্স্থ বিএডিসি’র পূর্বপাশে কীর্তনখোলা নদী সংলগ্ন বগুড়া আলেকান্দা মৌজার জে এল নং-৫০, খতিয়ান-৩৩৩ এর এস.এ দাগ নং-৫২৯১ এর ৭.২৫ শতাংশ জমি রেকর্ডিয় মালিকদের থেকে ক্রয় করেন ভুক্তভোগী নুরুল হক মৃধা। তিনি এই জমি ক্রয় করে দীর্ঘ বছর বসবাস করে আসছেন। কিন্তু হঠাৎই বিএডিসি কর্তৃপক্ষ বাউন্ডারি ওয়াল নির্মানের কাজ শুরু করেন। বিএডিসির অপরিকল্পিত বাউন্ডারি ওয়াল নির্মানের কারনে ভুক্তভোগি নুরুল হকের প্রায় ২.৫০ শতাংশ জমি বিএডিসির অভ্যন্তরে চলে যায় এবং তাদের যাতায়াতের পথটিও বন্ধের উপক্রম হয়। এতে ভুক্তভোগী নুরুল হক বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এম.পি কেস নং-৩৭৮/২০২৫(১৪৪/১৪৫ ধারা) দায়ের করেন এবং মোকাম বরিশাল সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে দেওয়ানী ১৫১/২০২৫ইং মোকদ্দমা দায়ের করেন। যা বর্তমানে উভয় আদালতে চলমান রয়েছে। এমতাবস্থায় এম.পি কেস নং ৩৭৮/২০২৫ (১৪৪/১৪৫ ধারা) এর বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরিশাল সদর ভূমি কর্মকর্তাকে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ইং তারিখে বরিশাল সদর ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার রিযাজ উদ্দিন সরেজমিনে যান। এসময় বিরোধীয় জমির কোন মাপজোক না করে শুধুমাত্র উপস্থিতি স্বাক্ষর নিয়া চলে আসে এবং ভুক্তভোগী নুরুল হককে পরে দেখা করতে বলে। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযুক্ত সার্ভেয়ার রিয়াজ বিবাদীপক্ষ থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে একটি মনগড়া-বানোয়াট ও হয়রানীমূলক রিপোর্ট প্রদান করেন।
এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী নুরুল হক বলেন, আমার দলিল, এস রেকর্ড অনুযায়ী আমি ৭.২৫ শতাংশ জমির মালিকানা দাবিদার। অথচ সরেজমিনে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ জমি পেয়েছি। বাকি জমি বিএডিসি কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে পরিকল্পনাহীন বাউন্ডারি ওয়াল নির্মান করে তাদের দখলে নিচ্ছে। আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমার জমি ফিরে পেতে বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও সহকারি জজ আদালতে মামলা দায়ের করি। এরই প্রেক্ষিতে বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে সদর ভূমি অফিসে সরেজমিনে তদন্ত রিপোর্ট চাইলে ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার রিয়াজকে আমার মালিকানার প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রাধি দেখালে সে পরে দেখা করতে বলে। আমি তাকে তার দাবিকৃত ঘুষ না দেয়ায় সে সরেজমিনে জমির মাপজোক না করেই একটি বানোয়াট, মনগড়া ও হয়রানীমূলক রিপোর্ট দাখিল করেন। আমি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমার মালিকানাধীন জমি ফেরত চাই আর এই ঘুষখোর সার্ভেয়ার রিয়াজের শাস্তির দাবি জানাই, যাতে আর কোন ব্যাক্তি হয়রানীর শিকার না হয়।
সূত্রে আরো জানাগেছে, ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার রিয়াজ উদ্দিন জমির মিউটিশনের আবেদন তার কাছে গেলেই ঘুষ বাবদ ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেন আবেদনকারীদের থেকে। এতে আবেদনকারী ব্যক্তিরা চরম ক্ষিপ্ত হলেও নীরবে সহ্য করেন রিয়াজের এ ঘুষ বাণিজ্যের অত্যাচার। স্বয়ং বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিও তার রোষানলে পড়ে, অবশ্য সে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত থাকায় তাকে বেশি বেগ পেতে হয়নি। আরো জানাযায়, সার্ভেয়ার রিয়াজ সরেজমিনে তদন্তে গেলেই শুরু হয় তার ঘুষবাণিজ্য। এতে তার উপরে চরম ক্ষিপ্ত ভুক্তভোগিরা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। বরিশাল নগরীর বাসিন্দা আলামিন সিকদার নামে এক ভুক্তভোগী সার্ভেয়ার রিয়াজ উদ্দিনের ছবিতে কমেন্ট করে লিখেন রিয়াজ ঘুষ খোর, আমাদের একটা ঘটনায় সরেজমিনে তদন্তে এসে মোটা অঙ্কের টাকা চায়। তাকে টাকা না দেয়ায় অপরপক্ষ থেকে অবৈধভাবে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মনগড়া রিপোর্ট প্রদান করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী আলামিন বলেন, আমার বাবা বিআইডব্লিউ এর থেকে নগরীর ফলপট্টির মুখে একটি স্টল বাৎসরিক হিসেবে লিজ নিয়া হোটেল ব্যবসা করেন। তিনি মারা যাবার পরে আমার বড় ভাই সেই দোকান নিজের দখলে নেন। এ ঘটনায় বরিশাল অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা হলে সার্ভেযার রিয়াজ তদন্তে গিয়া ঘুষ চাইলে আমার তা দিতে না পারায় আমার ভাইয়ের থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়া তদন্ত রিপোর্টে বিআইডব্লিউটির জমি উল্লেখ না করে তার দখলে আছে বলে রিপোর্ট প্রদান করেন। আর এভাবেই ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ সার্ভেয়ার রিয়াজের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তারাও সার্ভেয়ার রিয়াজের শাস্তির দাবি জানান।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত রিয়াজের কাছে জানতে চাইলে দুর্নীতি আর অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারবো না, আমি এসিল্যান্ড স্যারের সাথে কথা বলেন। এদিকে ছাত্রলীগ নেতা বশিরকে শেল্টার ও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে বিজ্ঞ আদালতে জামিনে সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, আমার ছোট শ্যালিকার সাথে বশিরের বিয়ে আমি মেনে নেইনি। এছাড়া তাকে কোন বিষয়ে কোন ধরণের সহায়তাও করিনি আমি। মুরাদুলকেও আমি চিনি না।
এ বিষয়ে বরিশাল সদর (ভূমি) সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আজহারুল ইসলাম বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগ প্রমানিত হলে সার্ভেয়ার রিয়াজের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, অভিযোগ দেয়া হলে অবশ্যই সেটি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Leave a Reply