শতাংশের হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা চলতি বছরের মার্চে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি খাতের তুলনায় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির গতি ছিল বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চারটি কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এগুলো হলোÑ ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় সুবিধা না থাকা, আগের প্রান্তিকের গোপন করা খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য নতুন প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকা কিছু রিট পিটিশন ভ্যাকেট হওয়া এবং সুদ চার্জ।
নানা রকম ছাড় ও সুবিধা দেওয়ার কারণেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এতদিন খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সঠিক হয়নি। এটি শুরু হয়েছিল বড় গ্রাহকদের ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে। এর পর থেকে বিভিন্ন কারণে একের পর এক ছাড় ও নীতিমালা শিথিল করার ঘটনা ঘটছে। বারবার সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার এই প্রবণতা উল্টো খেলাপি ঋণ বাড়াচ্ছে।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে এখন সংক্রামক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তা ছাড়া যারা বছরের পর বছর বারবার সুবিধা নিয়েও ঋণ ফেরত দিচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও দেখা যায় না। ফলে ঋণখেলাপিদের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে, ঋণ ফেরত না দিলেও কিছুই হয় না। আবার ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়েও যথেষ্ট সচেষ্ট নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এ ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। তারা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় না।
মহামারী করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালেও ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় সুবিধা অব্যাহত ছিল। ছাড় অনুযায়ী, ওই বছরে বকেয়া কিস্তির ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করেই নিয়মিত থাকার সুযোগ পান ঋণগ্রহীতারা। এতে গত বছরের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে আসে। তবে চলতি বছর থেকে এই সুবিধা আর রাখা হয়নি। যদিও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ঢালাও সুবিধা আগের মতোই অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। আর এসব ঋণ পরিশোধে ৫ থেকে ৮ বছর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির সুযোগ রাখা হয়েছে। যদিও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খুব একটা ঋণ পুনঃতফসিল হয়নি বলে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়টি হঠাৎ করে সৃষ্ট কোনো সমস্যা নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সমস্যারই ধারাবাহিকতা এটি। কারণ কয়েক বছর ধরে প্রতি প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অথচ এ সময়ে ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনসহ সব ধরনের সুবিধার দরজা উন্মুক্ত করা হয়েছে। কোনো সুবিধাই খেলাপি ঋণ কমাতে পারেনি। ব্যাংকগুলোর হাতে ঋণ পুনঃতফসিল করার ক্ষমতা দেওয়ার ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে এখন বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় নতুন কিছু একটা করতে না পারলে খেলাপি সমস্যা আরও প্রকট হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। তিন মাস আগে গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ফলে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। আর ২০২২ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।
বেশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকে : প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৫৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তিন মাস আগে এই ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল।
এই সময়ে বেসরসকারি ৪২ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৮৮৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। তিন মাস আগে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৫৬ হাজার ৪৩৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ ছিল।
একই সময়ে বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ। তিন মাস আগে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৭০৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বা ১২ দশমিক ৮০ শতাংশই। ২০২৩ সালের মার্চ শেষে বিদেশি ৯ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৪১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বা ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ। তিন মাস আগে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ।
৮৭ শতাংশই মন্দ ঋণে পরিণত : ব্যাংক খাতে আদায় অযোগ্য মন্দমানের খেলাপি ঋণ বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ শেষে এ খাতে মন্দমানের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৪৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা এ খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৮৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ। হাতেগোনা ৮ থেকে ১০টি ব্যাংকে মন্দ ঋণের আধিক্য বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব ঋণের বেশির ভাগই বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম, জাল-জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে বের করে নেওয়া হয়েছে। এই মানের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
Leave a Reply