নিজস্ব প্রতিবেদক // ভয়াবহ তাপদাহে অস্থির হয়ে উঠেছে জনজীবন। দুঃসহ গরমে গত এক সপ্তাহে ধরে হাঁসফাঁস অবস্থা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। তাই গরমে ঘরে-বাইরে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। একই সঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরমে অতিরিক্ত ঘামলে শরীর ডিহাইড্রেড হয়ে পড়ে। এর ফলে ডায়রিয়া, হিট স্ট্রোক, কলেরা, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, পেটের সমস্যা, সর্দি-জ্বর, হাঁপানি, গ্যাসের সমস্যা, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ত্বকে সমস্যা, নানা ধরনের অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু ও অন্তঃসত্ত্বাদের এ ঝুঁকি বেশি।
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, এবারের গরমে ভিন্নমাত্রা রয়েছে। বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তাপদাহের মধ্যে ঠোঁট শুকিয়ে ও ফেটে যাচ্ছে। বাতাসের জ্বলীয়বাষ্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে।
এ ছাড়া রোজায় দীর্ঘসময় পানি না খাওয়া অবস্থায় প্রচুর ঘাম হলে শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হতে পারে। তাই বেশি বেশি বিশুদ্ধ পানি পান করা, ফলমূলের শরবত পান, পচা-বাসী ও বাইরের খাবার না খাওয়া এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার পরামর্শও দেন বিশেষজ্ঞরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে তীব্র তাপদাহে শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশ থেকেই ডায়রিয়ার রোগী আসছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বা কলেরা হাসপাতালে।
রোগীরা ডায়রিয়া শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং হাঁটা-চলার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলছে। যদিও এখন পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
আইসিডিডিআরবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তীব্র গরমে কলেরা হাসপাতালে রোগীর চাপ প্রতি বছরই হয়। সাধারণত প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০ রোগী থাকে। কিন্তু গত কয়েক দিনের দুঃসহ গরমে রোগী ভর্তির সংখ্যা গড়ে ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে।
শনিবার আইসিডিডিআরবির সিনিয়র ম্যানেজার (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন) এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান সময়ের আলোকে বলেন, গত তিন দিনে কলেরা হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৫০৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।
এদিকে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে রোগীর চাপ গত কয়েক দিনে বেড়েছে বলে জানা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোজার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ। তবুও প্রচণ্ড গরমে শিশুদের সর্দি, জ্বর-কাশি বেশি হচ্ছে, যেটা ভাইরাল ফ্লু।
এ ছাড়াও টাইফয়েড ও পানিবাহিত হেপাটাইটিস, জন্ডিসের প্রবণতা বেড়েছে। স্কুল বন্ধ, তাই বেশির ভাগ শিশু বাসায়ই থাকছে।
তবু এসব রোগ বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ বলেন, প্রচণ্ড গরমে কিছু ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে হিট স্ট্রোক, সান স্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, জলবসন্ত, ডায়রিয়া, অ্যাসিডিটিসহ পেটের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ, গর্ভবতী নারী ও শিশু, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
তিনি বলেন, গরমের এই পরিস্থিতিতে ফলের শরবত, ডাবের পানি, লেবুর শরবত, স্যালাইন, গ্লুকোজ এবং পুষ্টিকর রসালো ফল বেশি করে খেতে হবে। এতে শরীর থেকে ঘাম হয়ে বের হয়ে যাওয়ায় পানির চাহিদা পূরণ হবে।
আর গরমে এ সময়ে শিশুদের ঘরের বাইরে না যাওয়া, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ও বরফ খাওয়া থেকে বিরত রাখার পরামর্শ দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, প্রচণ্ড গরমে শরীরের তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। এই সময় আমাদের হৃদপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হয় এবং রক্ত পাম্প করার জন্য একে বেশি পরিশ্রম করতে হয়।
এই কারণে ত্বকের ঘাম তৈরি হয়। আর প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে প্রবল। এ অবস্থায় শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে হিট স্ট্রোক হয়। এ ছাড়াও অতিরিক্ত গরমে ডায়রিয়া, সর্দি-জ্বর কাশিসহ পেটের সমস্যা, শরীরে হালকা র্যাশ বা দানা দেখা দিতে পারে, যা চুলকাতে পারে।
তিনি বলেন, বাইরে যারা কায়িক পরিশ্রমের পেশায় জড়িত, তারা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। বিশেষ করে সরাসরি সূর্যের নিচে যাদের কাজ করতে হয়, তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
এতে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থাকে। আর হিট স্ট্রোক হলে মাথা ঝিম ঝিম করে, বমি বমিভাব হয়, হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি, শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি পেটের সমস্যা, জ্বর, হাঁপানির সমস্যা হয়। কেউ যদি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েই যায় তা হলে তাকে যত দ্রুত সম্ভব ছায়াযুক্ত স্থানে নিতে হবে।
ঘরে থাকলে ফ্যান ও এসি চালু করে তাকে ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। আর গরমে বিশেষ সমস্যা হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, প্রচণ্ড গরমে মানুষের বিভিন্ন ধরনের অসুখ, সর্দি-কাশি, জ্বরও হচ্ছে। এর সঙ্গে প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিও যুক্ত হয়েছে।
অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের না হওয়া এবং অযথা রোদে না ঘোরার পরামর্শ দিয়ে এ ইমিরেটাস অধ্যাপক বলেন, যেসব বয়স্ক মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত তাদের হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। আর যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া তাদের বাইরে বের না হওয়াই ভালো।
আর বাইরে যদি যেতেই হয় তা হলে আঁটসাঁট পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঢিলেঢালা কাপড় পরা ভালো। এ ছাড়াও বাইরে গেলে ছাতা, টুপি, ক্যাপ ব্যবহার করতে হবে এবং পানির বোতল রাখতে হবে।
আর যারা কায়িক পরিশ্রম করেন কিংবা রিকশা শ্রমিক বা অন্যান্য কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা যেন মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন এবং বেশি করে পানি পান করেন।
তিনি বলেন, তীব্র গরমে রোজাদারদের দেখা দিতে পারে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা। তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়, রাগ বেড়ে যায়। এ ছাড়া যাদের ব্লাড প্রেশার রয়েছে তীব্র গরমে তাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
সর্দি-কাশি, জ্বর, অ্যাসিডিটিসহ হার্ট অ্যাটাকেরও আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। তাই গরমে সুস্থ থাকতে রোজাদারদের ইফতারের সময় সঠিক খাবার গ্রহণ করতে হবে।
খেতে হবে এমন সব খাবার, যা সহজে হজম হয় ও যাতে পানির পরিমাণ বেশি রয়েছে। আর তৈলাক্ত খাবার, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
Leave a Reply