নিজস্ব প্রতিবেদক // তাল গাছ থেকে তৈরি ও দেখতে ডিঙি নৌকার মতো বলেই হয়তো একে তালের ডোঙা বলা হয়। তালের নৌকা বলেও এর প্রচলিত নাম আছে।
বর্ষাকালে দেশের নিম্নভূমি, ডোবা-নালা, খাল-বিল যখন পানিতে থইথই করতে থাকে; তখন সেসব জলাভূমিতে যাতায়াত ও মাছ ধরার জন্য কোন্দা বা তালের ডোঙা ব্যবহার করা হয়। একটি তালের ডোঙা সাধারণত ১৫-২০ ফুট লম্বা হয় এবং চওড়া হয় ১-২ ফুট।
গাছের গোড়ার দিকটা থাকে গোলাকার ও বদ্ধ, অন্য প্রান্ত থাকে খোলা। তাই চলার সময় সে প্রান্তের মুখ কাদা দিয়ে বন্ধ না করলে পানি উঠে তালের ডোঙা ডুবে যেতে পারে।
এক-দু’জনের বেশি সাধারণত একটি তালের ডোঙায় ওঠা হয় না। বৈঠা নয়, একটি লম্বা চিকন শক্ত বাঁশের টুকরো দিয়ে পানির মধ্যে ঠেলে ঠেলে তালের ডোঙা চালানো হয়।
গ্রাম-গঞ্জের হারিয়ে যাওয়া অন্যতম একটি বাহন হলো তালগাছ দিয়ে তৈরি করা তালের ডিঙি (স্থানীয় নাম তালের ডোঙা)। একটি তাল গাছ লম্বালম্বিভাবে সমান দুইভাগে কেটে মাঝখানের নরম অংশটুকু তুলে ফেলে এগুলো তৈরি করা হয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে গ্রামের খাল-বিলে চলাচলের জন্য এর বিকল্প একসময় ছিল না।
তবে সময়ের সঙ্গে এই বাহনও বিলুপ্তির পথে। একসময় অনেকের পেশা ছিল তালের ডিঙি তৈরি করা। বর্তমানে তাদের দেখা মেলা ভার। তবে সেই ডিঙি ও এই ডিঙি তৈরি পেশার সঙ্গে জড়িত একজন কারিগরের দেখা মিলল ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের স্থানীয় গোচড়া নামক বাজারে।
বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আজিজ মল্লিক (৭৫) বেশ কয়েকটি তাল গাছ কেটে ডিঙি তৈরির জন্য নিখুঁত হাতে শাবল মেরে যাচ্ছেন। এ বয়সেও নিখুঁতভাবে বিরামহীন শাবল চালানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ কাজে তিনি অনেক পারদর্শী। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই এ পেশার সঙ্গে জড়িত। একসময় ডিঙির চাহিদা ছিল প্রচুর। তখন বর্ষায় দম ফেলার সময় পেতাম না।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তেমন চাহিদা নেই বললেই চলে। তারপরও গত বছরের আগের বছর ২২টি, গত বছর ১২টি ডিঙি তৈরি করে বিক্রি করেছি। এ বছর মাত্র ৮টি ডিঙি তৈরি করেছি। প্রতিটি তাল গাছ দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় কিনি। তারপর সেটা দুইভাগে কেটে দুটি ডিঙি তৈরি করি। যা প্রতিটা ৭-৮ হাজার টাকা বিক্রি করি।
এর জন্য উপযুক্ত তাল গাছ বাছাই করে কিনতে হয়। চাহিদা কমে যাওয়ায় আগামীতে আর এগুলো তৈরি করার ইচ্ছা নেই। ’ উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের গোচড়া গ্রামেই তার জন্ম। এখানেই ছোটবেলা থেকে বসবাস করে আসছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী ও সাত মেয়ে আছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।
পেশা থেকে অর্জিত আয়েই মেয়েদের স্থানীয় মাদরাসায় লেখাপড়া করিয়েছেন। অন্য সময়ে তিনি তাল গাছের পাতা দিয়ে পাখা তৈরি করেন। সেগুলো জেলার বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন। এ কাজে তার পরিবারের অন্য লোকজন সহায়তা করেন। বর্তমানে তার স্ত্রী তালপাখা তৈরিতে তাকে সহায়তা করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘আজিজ চাচা আমাদের এলাকার একজন কর্মঠ মানুষ। তার তৈরি হাতপাখা ও তাল গাছের ডিঙিতে শিল্পের আঁচড় থাকে। তাকে আমরা কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। বয়স তার কাছে একটা সংখ্যামাত্র।’
সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী জেসমিন ওবায়েদ বলেন, ‘তিনি আমার ইউনিয়নের সবচেয়ে বয়স্ক কর্মঠ মানুষ। তার জন্য দোয়া রইলো। যারা নিজের পেশাকে আঁকড়ে থাকতে চান, তিনি তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
Leave a Reply