বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ২০২১ সালে সিলেট ও চাঁদপুর জেলা থেকে ২ জন তরুণ নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হলে ডিএমপি’র সিটিটিসি ছায়া তদন্ত শুরু করে। গত বছরের ১৫ নভেম্বর সাইফুল ইসলাম তুহিন তাবলীগে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয় এবং একই বছরের ২৭ নভেম্বর তার পরিবারের পক্ষ থেকে ওসমানী নগর থানায় একটি জিডি করা হয়। সে কওমী মাদ্রাসায় ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করে ওসমানীনগর থানাধীন দয়ামীর নামক স্থানের একটি কমিউনিটি সেন্টারে নাইট গার্ডের চাকরি নেয়।
গ্রেপ্তার সাইফুল ইসলাম তুহিন স্থানীয় এক মাওলানার সাহাচার্যে এসে হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে ঐ মাওলানাসহ স্থানীয় আরও দুইজন গত বছরের ১৫ নভেম্বর ফজরের নামাজের পর যার যার বাড়ি থেকে বের হয়ে শেরপুর গোল চত্ত্বরে একত্রিত হয়। এরপর সিলেট থেকে আরও চারজনসহ মাইক্রোবাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে গাড়িতে থাকা এজেন্ট তাদের দাড়ি কেটে দেয়, মোবাইল, এনআইডি, মানি ব্যাগ ও টাকা নিয়ে নেয়। এরপর তারা প্রথমে ঢাকা ফকিরাপুল যায় এবং বাসে করে বান্দরবন যায়। বান্দরবন গিয়ে তারা দেখতে পায় গাড়িতে তাদের মতো আরও ১০ জন হিজরতকারী আছে। তাদের সবাইকে ভুয়া এনআইডি ও নাম দিয়ে প্রথমে থানচি ও পরে ১২ ঘন্টা পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটিয়ে কেটিসি নামক ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
গ্রেপ্তার নাঈম হোসেন ঢাকার শেরেবাংলানগরে এগ্রিকালচার ট্রেইনিং ইনস্টিটিউটতে (এটিআই) কৃষি ডিপ্লোমাতে ৪র্থ সেমিস্টারে পড়তো এবং সেখানকার হলে থাকতো। গত বছরের ২ অক্টোবর কাউকে কিছু না বলে হল থেকে চলে যায় হয় এবং পরদিন তার পরিবারের পক্ষ থেকে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি জিডি করা হয়।
২০২১ সালের প্রথম দিকে করোনার কারণে কলেজ বন্ধ হলে সে বাড়ি চাঁদপুরে চলে যায়। এ সময় কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে পড়ার জন্য চাঁদপুরের একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। ওই মাদ্রাসার এক হুজুরের মাধ্যমে সে জিহাদের জন্য উদ্বুদ্ধ হয় এবং এই জঙ্গি সংঘঠনে নাম লেখায়। ২০২১ সালের মাঝামাঝি সে ঢাকা চলে আসে এবং গোপন এ্যাপসের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। গত বছরের অক্টোবর সকালের দিকে সে হিজরতের উদ্দেশ্যে হল ছেড়ে প্রথমে কুমিল্লা গিয়ে তার রিক্রুটারের কাছে যায়। সেখানে বিভিন্ন সেফ হাউজে মাসাধিকাল অবস্থান করে। নভেম্বরের ৮-১০ তারিখে সেসহ আরও প্রায় ১২-১৩ জন কুমিল্লা বাস স্টপ থেকে বান্দরবনের বাসে উঠে। সেখান থেকে তারা চান্দের গাড়ি করে প্রথমে থানচি পৌঁছে।
পরে বান্দরবানে তাদের সহযোগী কেএনএফ সদস্যরা রিসিভ করে। থানচি থেকে প্রায় ২ ঘন্টা চাঁন্দের গাড়িতে গিয়ে তারপর প্রায় ১০ ঘন্টা হেঁটে কেটিসি ক্যাস্পে পৌঁছান। তারা এই ক্যাম্পের ২য় হিজরতকারী দল। চলতি বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কেএনএফ তাদের জানায় যে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে পারে। অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ রাত তিনটার দিকে কেএনএফ কমান্ডার এসে তাৎক্ষণিক তাদের ক্যাম্প ছেড়ে যেতে বলে। তারা দ্রুত ক্যাম্প ছেড়ে কয়েক ঘন্টা হাঁটার দূরত্বে একটি জঙ্গলে অবস্থান গ্রহণ করে।
প্রায় খাবার ও পানীয়হীন অবস্থায় এভাবে দুদিন চলে গেলে ও কেএনএফ আর ফেরত না আসলে তারা বাধ্য হয়ে আবার সিপ্পি ক্যাম্পে ফেরত আসে। সেখানে সে রাতেই তারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে ২১ ও ৩২ জনের দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে ২১ জনের গ্রুপ ক্যাস্পে অবস্থান করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ৩২ জনের গ্রুপটি হাঁটতে একটি জঙ্গলে অবস্থান নেয়।
তুহিন ও নাঈম এই গ্রুপে ছিলো। পরে তারা হাঁটতে হাঁটতে গত বছরের ১৬ অক্টোবর তারপং খালে পৌঁছায়। সেখানে তারা আবারও আক্রমণের শিকার হয়। সে আক্রমণে তুহিন ও নাঈম ও আরও একজন দলছুট হয়ে পড়ে এবং সমতলের উদ্দেশ্যে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকে। এভাবে তিনদিন হাঁটার পর তারা একটি মারমা পাড়ায় এসে উপস্থিত হয়। এই তিনদিন তারা সামান্য কয়েক প্যাকেট বিস্কিট, পাহাড়ি কাচা কলা, বাঁশের কঁচি অংশ এবং ঝিড়ির পানি খেয়ে জীবন ধারন করে।
মারমারা তাদের বম পাড়ায় পাঠালে বম’রা তাদের তিনজনকে কেএনএফ এর কাছে তুলে দেয়। কেএনএফ’র সাথে তারা জঙ্গলে মাসাধিকাল অবস্থান করে গত ২৫ নভেম্বর তিনজন সমতলে পৌঁছে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় সিটিটিসি খবর পেয়ে যায় এবং তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তুহিন ও নাঈমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সিটিটিসি জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের ভাষ্যমতে, কেটিসি ক্যাম্পে তারা প্রায় ৪ মাসের মত ছিলো। এসময় প্রথম ৩০ দিন তাদের ১২ জনকে তাদের পাহাড়ি সহযোগী কেএনএফ সদস্যরা পাশের পাহাড়ে ট্রেনিং করায়। সে সময় অন্যান্যদের পিটি-প্যারেড, ক্যাম্প পাহারা, রসদ সংগ্রহ, ঘর তৈরী ও রান্না-বান্নার কাজ করতে হতো। এ সময় আরও কিছু হিজরতকারী সেখানে পৌঁছায়। একমাস পর তাদের পিটি-প্যারেডের সাথে রাত্রিকালীন সময়ে পাহাড়ে হাঁটার অনুশীলন করায় প্রায় আরও একমাস। তারপর আরও মাসেকখানি তাদের পিটি-প্যারেডের সাথে ডামি অস্ত্র এবং শেষে এয়ারগান ও বন্দুক দিয়ে অনুশীলন করায়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা আরও জানায়, তারা সেখানে যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারে মুলত শামীম মাহফুজ ওরফে স্যার ছিলো তাদের মূল নেতা। তার পরিকল্পনা অনুসারেই ক্যাম্পের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতো। আমির ওরফে আনিসুর ওরফে মাহমুদ, তমাল, রাকিব, ডাক্তার ভাই ওরফে ডা. শাকের, ক্যাম্প কমান্ডার কারসে ওরফে শিব্বির সবাই স্যারের পরামর্শ নিয়েই কাজ করতো। তিনি আলাদা ঘরে থাকতেন এবং তার জন্য সশস্ত্র পাহারাদার থাকতো।
কেএনএফ নেতা নাথান বম ক্যাম্পে আসলেও শুধুমাত্র তার সাথেই দেখা করতো ও কথা বলতো।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে একদিন নামাজের পরে স্যার ওরফে শামিম মাহফুজ এবং আমির ওরফে আনিসুর রহমান তাদের সামনে দলের নাম ঘোষণা দেয়, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকিয়া। সেখানে সবাই ছদ্মনাম ব্যবহার করতো। কয়েক দিন পর তারা জানতে পারে যে, তারা মিজোরাম হিজরত করবে। সেখানেই তাদের ট্রেনিং হবে। সে মতে তারা সব কিছু গুটিয়ে তাদের ৫৫ জন এবং কেএনএফ এর প্রায় ২০০ জন মিজোরামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
টানা ৫-৬ দিন হেঁটে তারা মিজোরাম সীমান্তে পৌঁছে সপ্তাহ খানেক জঙ্গলে অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত ঢুকতে না পেরে তারা আবার ৬-৭দিন হেঁটে একটি পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে এর নাম দেয় রেতেলাং ক্যাম্প। এখানে প্রায় দুইমাস অবস্থানের পর হঠাৎ একদিন অন্য একটি পাহাড়ি বিছিন্নতাবাদী গ্রুপের মাধ্যমে (জেএসএস) আক্রান্ত হয় এবং ব্যাপক গোলাগুলি হয়। এতে তাদের ডা. আহমদ নামে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। পরদিন জানাজা শেষে শামীম মাহফুজ ওরফে স্যার এই ক্যাম্পের নাম দেয় শহিদ ডা. আহমেদ ক্যাম্প। পরে ঐ ক্যাম্প ছেড়ে তারা সিপ্পি নামক পাহাড়ে নতুন করে ক্যাম্প তৈরী করে। এর নাম রাখা হয় ’সিপ্পি ক্যাস্প’। শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার ও আমির মাহমুদ এ ক্যাম্পে কিছুদিন থাকার পর সমতলে চলে আসে। সেখানেই তারা এ বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অবস্থান করে।
গ্রেপ্তার তুহিন জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে সহ সিলেট থেকে যাওয়া চারজন সেখানে থেকে চলে আসতে চাইলে তাদের টানা কয়েকদিন গাছের সাথে বেঁধে রাখে, একবেলা খাবার দেয় এবং শেষে তাদের সাথে লিখিত চুক্তি করে। তাতে বলা হয় ২০২৩ সাল পর্যন্ত থাকতে হবে। এসময় তারা আলাদা থাকবে, নিজেরা রান্না করে খাবে, কারো সাথে কথা বলবে না প্রভৃতি। একদিন এই চারজন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যায় এবং বমদের হাতে ধরা পড়ে। তখন তাদের উপর নেমে আসে অমানুষিক অত্যাচার।
১০০/৬০/৫০ প্রভৃতি সংখ্যার র্দোরার পাশাপাশি তাদের সাথে সেই পুরানো আমলের দাস-দাসীদের যে আচরণ করা হতো সেই আচরণের শাস্তি জারি করা হয়। সবার কাপড় ধোয়া, লাকড়ি কাটা, সীমিত ভাত-পানি দেয়া এবং কাজ শেষে আবার হাত পা বেধেঁ ফেলে রাখা প্রভৃতি ছিলো সেই শাস্তির ধরণ, যা প্রায় তিন মাস পর্যন্ত বলবত ছিলো।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা সকলেই নব্য উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সক্রিয় সদস্য। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য মূলতঃ জঙ্গিবাদের জন্য সদস্য রিক্রুটমেন্ট, অর্থ সংগ্রহ, সশস্ত্র সামরিক ট্রেনিং, আধুনিক অস্ত্র ক্রয়সহ বিশাল জঙ্গি বাহিনী গঠন করা। তাদের উদ্দেশ্যে পূরণকল্পে তারা দেশব্যাপী ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭০/৮০ জন যুবককে এই সংগঠনের সদস্য করেছে।
সংগঠনের উদ্দেশ্যে ছিলো পাহাড়ে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি, নিরাপদ সামরিক ট্রেনিং, সংগঠনের উগ্রবাদী উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকল্পে দেশে নাশকতা সৃষ্টির মাধ্যমে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে পুনরায় নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া।
গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১টি মামলা হয়েছে।
Leave a Reply