নিজস্ব প্রতিবেদক:: বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমিকে ঘিরে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত জেলা কালচারাল অফিসার অসিত বরণ দাশ গুপ্তকে বিতর্কিত করতে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত এক প্রভাবশালী গোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রভাব বিস্তারকারী এই গোষ্ঠী এখন একাডেমির নিয়ন্ত্রণ হারানোর আশঙ্কায় নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে বরিশাল জেলা শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শাখায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি। এদের কেউ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আত্মীয়, কেউবা স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাবেক নেতা। সরকারি চুক্তির ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনকারী এই প্রশিক্ষকদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে নতুন নিয়োগের সুযোগ তৈরির পর তারা একাডেমির পরিচালনার ওপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নানা অপকৌশল গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। একাধিক সংস্কৃতিকর্মী অভিযোগ করেছেন, পূর্বতন কালচারাল অফিসার হাসানুর রশীদ চৌধুরী (মাকসুদ) কে নিয়ে এই পুরনো গোষ্ঠীটি দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একাডেমিকে কার্যত ‘একচেটিয়া’ভাবে চালিয়ে আসছিল। মিলনায়তন ভাড়া আত্মসাৎ, প্রশিক্ষণ কোর্সের ফি তছরুপ, অনুষ্ঠান না করে শুধুমাত্র কয়েকজনকে বসিয়ে ছবি তুলে বিল/ভাউচারের মাধ্যমে বিল উত্তোলন, অদক্ষ অথচ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে শিক্ষক পদে নিয়োগ, এবং প্রকৃত শিল্পীদের বঞ্চনার অভিযোগ বহুবার উত্থাপিত হলেও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় তারা বহাল তবিয়তেই ছিলেন। এ অবস্থায় চলতি বছরের শুরুতে জেলা কালচারাল অফিসার হিসেবে দায়িত্ব নেন অসিত বরণ দাশ গুপ্ত । তিনি বলেন, “আমি সরকারি নিয়ম মেনে একাডেমির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে চাই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অনিয়ম চিহ্নিত করে সংস্কার কাজ শুরু করেছি। কিন্তু পূর্বতন স্বার্থান্বেষী মহল এই পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। যোগদানের পর থেকে বিগত মাত্র সাড়ে ৩ মাসে শিল্পকলার নানাবিধ কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান আয়োজন, কর্মপরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন, জন ও সংস্কৃতিবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি দেখে স্বার্থান্বেষী মহলটি সহ্য করতে না পেরে এমন হীন ষড়যন্ত্র করছে।” বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ইতোমধ্যে কালচারাল অফিসারের বিরুদ্ধে ‘অযোগ্য’, ‘অসাংস্কৃতিক’ এমনকি ‘দলবিরোধী’ তকমা দিয়ে পোস্ট ছড়ানো হয়েছে। অথচ বরিশালের সংস্কৃতি অঙ্গনের একটি বিশাল অংশ অসিত বরণের স্বচ্ছতা ও সংস্কারের প্রশংসা করছেন। তিনি বলেন “বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক কর্মজীবনে আমি আমার কাজের জন্য ইতোমধ্যে ২০১৮ সালে সৃজনশীল কালচারাল অফিসার সম্মাননা, ২০১৯-২০২০, ২০২০-২০২১, ২০২১- ২০২২ পরপর তিন অর্থবছরে দেশ সেরা কালচারাল অফিসার হিসেবে পুরস্কার পেয়েছি এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি লিটল ম্যাগাজিন সম্মাননা পেয়েছি।” এখন বরিশালের সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করতে চাই।
একজন প্রবীণ নাট্যজন বলেন, “শিল্পকলা একাডেমি কোনো দলের নয়—এটি সবার। যিনি দায়িত্বে আছেন, তাকে কাজ করতে দিতে হবে। না হলে শিল্পচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” এদিকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পুরনো প্রশিক্ষকদের নবায়ন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় প্রশাসনের ভেতরে চাপ সৃষ্টি করছে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ পন্থীরা। যাতে তাদের অনুগত পুরনো প্রশিক্ষকরাই আবার নিয়োগ পান। বিশ্লেষকদের মতে, একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যখন দীর্ঘদিন একদল রাজনৈতিক ব্যক্তির দখলে থাকে, তখন সেখানে গঠনতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা হারিয়ে যায়। বরিশাল শিল্পকলা একাডেমি তার ক্লাস, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশনায় বিগত কয়েক বছরে পিছিয়ে পড়েছে, যার অন্যতম কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বরিশালবাসী ও সংস্কৃতি অনুরাগীরা এখন প্রশ্ন তুলেছেন—একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যবহৃত হতে পারে? শিল্প ও সংস্কৃতির এই তীর্থভূমিকে রক্ষায় শিগগিরই প্রশাসন ও সমাজের বিবেকবান অংশকে এগিয়ে আসতে হবে, না হলে শিল্পকলা একাডেমির ‘শিল্প’ই হারিয়ে যাবে রাজনীতির অন্ধকারে।
Leave a Reply