নিজস্ব প্রতিবেদক // ইলিশের মৌসুমেও হাসি নেই ভোলার মনপুরার জেলেদের মুখে। জাটকা রক্ষা কর্মসূচির দুইমাস পেরিয়ে গেলেও জেলেদের জালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। মেঘনা নদীতে নাই ইলিশ, ডাঙ্গায় এনজিওর ঋণের চাপ।
এ অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কিভাবে কোরবানের ঈদ কাটাবেন, তা নিয়েই চিন্তিত জেলেরা। দুইদিন পর ঈদুল আজহা আনন্দে মাতবে সবাই। এ ঈদকে ঘিরে মানুষের ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। তেমনি আনন্দেরও কমতি নেই। ঈদ উপলক্ষে দেশের সব বাজারগুলো জমজমাট, সর্বস্তরের মানুষ যখন প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত, সেই সময় ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে ভোলা মনপুরা উপজেলা জেলে পরিবারের মাঝে।
ঈদ এলেও যেন ঈদের আনন্দ নেই জেলে পরিবারের মাঝে। উপজেলা জেলে পল্লীদের কান্না শুধুই চারপাশের বাতাস ভারী হচ্ছে আর হাহাকার ছড়াচ্ছে। সীমাহীন দুর্দশা, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তাদের দিনরাত একাকার। সমুদ্রে ৬৫ দিন অবরোধ জেলে পল্লীতে ঈদের আনন্দ এখন বিলাসিতার নামান্তর। ঈদের আনন্দ সবার হৃদয়ে কড়া দিলেও দিচ্ছে না মনপুরার জেলে পল্লীদের মাঝে।
একদিকে এনজিও, অন্যদিকে মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে জেলেদের। তার ওপর রয়েছে সংসারের খরচ। কোনো জেলে পরিবারে দুবেলা দুমুঠো ভাতও জুটছে না। সব মিলিয়ে জেলে পরিবারগুলো এখন চরম বিপাকে রয়েছে। এ সময় জেলেপল্লিতে মাছ বিক্রি করে ঈদের উৎসবের আমেজ থাকবে সেখানে জেলেপল্লিতে চরম সংকটের মুখে অভাব অনটনের মধ্যে জীবন-যাপন করছেন জেলেরা, চলছে নীরব হাহাকার।
মার্চ-এপ্রিল দুই মাস মেঘনা ৯০ কিলোমিটার নিষেধাজ্ঞার পর নদীতে ইলিশ না থাকায় তাদের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। ধারদেনা করে আবারও সংকটে পড়ার শঙ্কায় দিশেহারা জেলেরা। কোরবারনের ঈদে কোরবান তো দূরের কথা ঈদের দিন ঘরে মিষ্টান্ন ও শিশুদের গায়ে নতুন জামা উঠবে কিনা তা নিয়েই যত দুশ্চিন্তা।
দিন রাত নদীতে জাল ফেলে যে দু-চারটি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে তাতে খরচের টাকাও উঠছে না। এছাড়াও সমুদ্র রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।চরম বিপাকে পরেছে জেলে পরিবার ও জেলেদের সাথে সম্পৃক্ত থাকা অনেকে। উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, মনপুরা নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৪ হাজার ৪শ ৪৮ জন। অনিবন্ধিত সব মিলিয়ে এ উপজেলা প্রায় অর্ধলক্ষ জেলে আছেন বলে ধারণা করেন।
মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে প্রতি মাসে প্রত্যেক নিবন্ধিত জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। এছাড়াও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য গরু ও উপকরণ দেওয়া দেওয়া হয়। গভীর সমুদ্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় সমুদ্রগামী জেলেদেরেকেও প্রণোদনা চাল বিতরণ করা হয়েছে।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, জনতা বাজার, হাজিরহাট, রামনেওয়াজ, মাঝেরঘাট ভূইয়ার হাট মাছঘাটে জেলেরা অলস সময় পার করছেন। নদীতে মাছ না থাকায় জেলেরা পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। ঈদে স্ত্রী-সন্তানের জন্য নতুন জামা-কাপড় কেনা তো দূরের কথা, দু’বেলা দুমুঠো খেতেই হিমশিম খাচ্ছেন জেলেরা।
বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও নেই। এসময়ে সরকারি খাদ্য সহায়তার চালও ঠিকমতো পাচ্ছেন না জেলেরা। ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। এনজিওর কর্মকর্তার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক জেলে। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার জেলেসহ আড়তদার, পাইকার ও মাঠপর্যায়ে মাছ বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকার বেশি জেলের পরিবারের প্রায়ই একই অবস্থা।
কথা হয় দক্ষিণ সাকুচিয়ার তালতলা ঘাটের জেলে বসির মাঝির সাথে, তিনি জানান, গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিদিনই তিনি নদীতে গেছেন। ঈদ উপলক্ষে ছেলে-মেয়েদের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দেওয়ার আশায় প্রতিদিনই জাল ফেলেছেন।
কিন্তু আশানুরুপ ইলিশ পাওয়া যায়নি। যা পাওয়া গেছে, তা বিক্রি করে তেল খরচ আর সহকারীদের দিয়ে কোন রকম চাল কিনছেন। তবে ঈদ উপলক্ষে ছেলে-মেয়েদের জন্য রুচি সম্মত খাবার কিনতে পারেনি। আর তার কাছে ঈদে সন্তানদের নতুন জামা দেওয়াটাও এখন স্বপ্নের মত।
উপজেলা উত্তর সাকুচিয়া চর গোয়ালিয়া গ্রামের জেলে রফিক মাঝির ছেলে ছোট আরমান এর সাথে কথা হলে সে বলে, ‘গত ঈদে বাবা সাগরে ছিলো মা নতুন জামা কিনে দিছে। কিন্তু এবার বাবা বাড়িতে তারপরেও জামা প্যান্ট কিছু এখনো আনে নাই।
বাবাকে প্রতিদিন বলি আনার জন্য কিন্তু এখনও আনে নাই।’ এলাকার অন্য সহপাঠীরা ঈদের নতুন জামা কিনেছে। তাই সেও তার বাবার কাছে আবদার করে নতুন জামার জন্য। মাঝের ঘাটের জাহাঙ্গীর মাঝি বলেন, সাগরে অভিযান চলে তাই আমরা সাগরে যেতে পারছিনা। এই দিকে এনজিও থেকে বড় অংকের ঋণ নিয়ে বোট এর কাজ ও জাল করেছি।
সাগরে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখন ঋণ এর চাপে দিশেহারা হয়ে পরছি। নিষেধাজ্ঞা এই সময় যাতে সরকার জেলেদের কথা চিন্তা করে এনজিও ঋণের কিস্তি বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করেন। জনতা ঘাটের আবুল মাঝি বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা সরকারি ঋণ পায়। কিন্তু আমরা প্রায় ১ কোটি টাকা খরচ করে বোট তৈরি করে সাগরে গিয়ে মাছ শিকার করে সরকারকে রাজস্ব দিছি। কিন্তু আমরা বোট তৈরির সময় সরকারি কোন ঋণ বা সুযোগ সুবিধা পাই না।
সরকারি ব্যাংক গুলোতে সল্প সুদে বোটরে কাগজ পত্র জমা রেখে ঋণ এর ব্যবস্থা যাতে করেন। সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা না পেয়ে এনজিওে থেকে ঋণের কিস্তি নিতে হয়। এতে করে নিষেধাজ্ঞা সময় এনজিও ঋণের কিস্তি ভয়ে এলাকা ছাড়তে হয়।
হাজিরহাটের আড়দার গিয়াসউদ্দিন আযম বলেন, নদীতে আশানুরূপ ইলিশ না থাকায় আমাদের ব্যস্ততা কম। ভরা মৌসুমেও জেলেরা নদীতে গিয়ে শুধু ইলিশ নয়, অন্য প্রজাতির মাছের দেখাও পাইনি। দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর তেমন কোনো মাছ ঘাটে আসেনি। এ কারণে ঘাটে বেচাকেনা নাই বললেই চলে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিক্টর বাইন জানান, ইলিশ একটি পরিভ্রমণশীল মাছ। এবার রোদ বেশি হওয়ায় বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। নদীতে ডুবোচরের কারণে মেঘনায় ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টি বাড়লে মেঘনায় আবারও ইলিশ ধরা পড়ার হার বাড়বে।
এছাড়া মনপুরা সমুদ্রে নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেদের মাঝেও ভিজিএফ এর চাউল বিতরণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে ঈদের সময় জেলেদের সহায়তা করা হয় সেই বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করবো।
Leave a Reply