নিজস্ব প্রতিবেদক // গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দৃশ্যমান সর্বশক্তি নিয়োগের পরও আওয়ামী লীগের সৎ, সজ্জন হিসেবে পরিচিত প্রার্থী আজমত উল্লা খান হেরে গেছেন। সরকার তথা আওয়ামী লীগের অর্জন সুষ্ঠু নির্বাচন। দলটির নেতারা বলছেন, গাজীপুরের মতো বাকি চার সিটিতেও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে রাজশাহী এবং খুলনায় ক্ষমতাসীন দলের অবস্থান ভালো হলেও বরিশালে ততটা সুবিধাজনক নয়।
গাজীপুরের মতো বরিশালে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী না থাকলেও দলে আছে দ্বন্দ্ব-বিভেদ। পাশপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম শক্তিশালী প্রার্থী। এমন বাস্তবতায় ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে গাজীপুরের মতো বরিশালেও পরাজয় ঘটতে পারে আওয়ামী লীগের, ডুবতে পারে নৌকা।
এ নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বরিশালের সন্তান জাহাঙ্গীর কবির নানক। দলের পক্ষে বরিশালে কেন্দ্রীয় প্রচার কমিটিতেও রয়েছেন তিনি।
নানক বলেন, ‘মান-অভিমান মিটে গেছে। সবাই একযোগে কাজ করছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।’
আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটিতে নির্বাচন হবে। সে হিসাবে ভোটের আর বাকি তিন দিন। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল, সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কাজ করছে নগরে।
বরিশাল সিটিতে এবার বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। এ নিয়ে চাচা, ভাতিজার মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পেয়েছে।
সাদিক আব্দুল্লাহ বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিপুলসংখ্যক অনুসারী রয়েছে তার। তার বাবা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। তাকেই কেন্দ্রীয় প্রচার প্রতিনিধি দলের প্রধান করা হয়েছে। তিনি ভাইকে নিয়ে একাধিক দলীয় কর্মসূচিও পালন করছেন; করেছেন কোলাকুলিও, তবে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলেছে, এ বিভেদ মেটার নয়।
সূত্রগুলো বলেছে, বাবা-ছেলে তাদের জায়গায় অন্য কাউকে দেখতে চান না। দলের বৃহৎ অংশ দুজনের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই তারা কেউ প্রার্থীর পক্ষে আন্তরিকভাবে কাজ করবেন না।
বরিশালের প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী নেতাকর্মী এবং পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সমর্থক নেতা-কর্মীরা খোকন সেরনিয়াবাতকে সমর্থন দিচ্ছেন, কিন্তু বরিশালের প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কম। একসময় তিনি যুবলীগের সদস্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে যান।
এদিকে চাচা-ভাতিজার মন কষাকষির পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার বিরোধিতাও এখন বরিশালের মানুষের মুখে মুখে। সাদিক আব্দুল্লাহর অনুসারীরা প্রথম দিকে নির্বাচনী মাঠে না থাকলেও এখন দৃশ্যমান। তবুও সংশয় রয়েই যায় যে, তারা আদৌ আন্তরিকভাবে কাজ করবেন কি না। কেননা সাদিক চাচার পক্ষে ঢাকা থেকে বৈঠকে যোগ দিলেও শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে দুই পক্ষ আলাদা কর্মসূচি পালন করে। এতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে, মামলা হয়।
এর আগে খোকনের মনোনয়ন ঘোষণার পরও এক দফা সংঘর্ষ হয়। তখন থেকে কিছু নেতা-কর্মী এখনও জেলে রয়েছেন।
বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আবুল খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দীন বলেন, ‘এখন দৃশ্যমান বিরোধ নেই। আমরা চেষ্টা করব নৌকার সব ভোট যেন খোকন সেরনিয়াবাত পান। তাহলে কেউ বিজয় ঠেকাতে পারবে না।’
এদিকে ইসলামী আন্দোলনের মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম শক্তিশালী প্রার্থী। গত দুই বছরের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামী আন্দোলন শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪০ হাজারেরও বেশি ভোট পায় ডানপন্থি রাজনৈতিক দলটি। এ ছাড়া বরিশাল সিটি নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার দিন বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ দেয়।
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ‘টেবিলঘড়ি’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কামরুল আহসান বিএনপি ঘরানার স্বতন্ত্র প্রার্থী। তিনি বরিশালের বিএনপি দলীয় প্রয়াত মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে।
কামাল বরিশাল নগর বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।২০১৩ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেনকে ১৭ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন তিনি। বাবার এই প্রভাব কামরুলের ক্ষেত্রেও কাজ দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া অধিকাংশ ওয়ার্ডে বিএনপি-জামায়াতের কাউন্সিলর প্রার্থী থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বিএনপির সমর্থকদের ভোট পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
দলের হয়ে বরিশাল সিটি নির্বাচনের প্রচার কমিটিতে থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘খোকন আবদুল্লাহ ও সাদিক আব্দুল্লাহ চাচা-ভাতিজা, একই পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তবে এখন সবাই একযোগে কাজ করছেন।
‘তাদের দুজনেরই অভিভাবক দলের সিনিয়র নেতা আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। নৌকার জয় হবেই ইনশাআল্লাহ।’
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঙ্গে। তিনি আওয়ামী লীগের বিভেদকে দেখছেন স্বার্থের দ্বন্দ্ব হিসেবে।
রাজনৈতিক এ পর্যবেক্ষক বলেন, ‘রাজত্ব হারানোর ভয়ে একটি অংশ মেয়র প্রার্থীকে সহায়তা করবে না, এটা স্বাভাবিক। দল ঐক্যের চেষ্টা করছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দূরত্ব রয়েই যাবে; বরং তারা বিরোধী পক্ষকে নির্বাচিত দেখতে চাইবে যাতে নিজেদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি নষ্ট না হয়।
Leave a Reply