বিশেষ প্রতিবেদক:: আরবি পঞ্জিকা অনুযায়ী দেশে এবারের রমজান মাস শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আগামী ২৪ মার্চ। অর্থাৎ রোজা আসতে বাকি রয়েছে আর ৭৬ দিন বা আড়াই মাসের মতো। এই রোজার মাসে বেশ কিছু পণ্যের যেমন চাহিদা বাড়ে, তেমনই বাড়ে দাম। বিশেষ করে প্রতি বছর রোজার ১৫ দিন আগে শবেবরাতের আগে পণ্যমূল্য বাড়ে এক দফা, রোজা শুরুর আগ দিয়ে বাড়ে আরেক দফা। পুরো রোজার মাসে অস্বাভাবিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে কষ্টের শেষ থাকে না সাধারণ মানুষের। এবারের রোজাতেও দেশের মানুষকে ভোগাতে পারে প্রধানত ৮টি পণ্য। পণ্যগুলো হচ্ছে- চিনি, ভোজ্য তেল, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, খেজুর, আটা-ময়দা ও চাল।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের রোজায় এই আট পণ্যে ভোক্তার কষ্ট পাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ, বিগত এক বছর ধরেই এসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে আছে। রোজার আগে শবেবরাতে বাড়বে আরেক দফা এবং রোজার শুরুতে শেষ দফা বেড়ে ভোক্তার কষ্ট চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে।
আরেক বড় কারণ রোজায় যেসব পণ্য বাজারে থাকবে সেগুলো আমদানির জন্য এখন এলসি খোলা হচ্ছে, কিন্তু ডলার সংকটের কারণে এসব খাদ্যপণ্য আমদানিতে পর্যাপ্ত এলসি খোলা যাচ্ছে না। এমনিতেই রোজায় এসব পণ্যের চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। পর্যাপ্ত এলসি খুলতে না পারায় রোজার বাজারে এসব নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে বাজার বিশ্লেষক ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সর্বপ্রথম সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে যে, বিগত যে কোনো বছরের রমজানের তুলনায় আসন্ন রোজার বাজার পরিস্থিতির চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা হবে। কারণ বিগত প্রায় এক বছর ধরে দেশের বাজারে এক সঙ্গে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে, অতীতে কখনো এক সঙ্গে এভাবে বাড়েনি সব পণ্যমূল্য। এর প্রভাব রোজার মাসেও থাকবে, বরং রোজার আগে অন্তত দুই দফা আরও বাড়বে। সে জন্য সরকারের পাশাপাশি দেশে যারা ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী রয়েছেন তাদের যেকোনো বছরের চেয়ে এবার দ্বিগুণ-তিনগুণ প্রস্তুতি নিতে হবে। নতুবা এসব পণ্য এবারের রোজায় চরমভাবে ভোগাবে ভোক্তাকে। সুতরাং রোজার মাসে যাতে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। সরকারের উচিত রমজানকেন্দ্রিক পণ্য আমদানি করা, যাতে ব্যবসায়ীদের কোনোরকম ঝামেলায় পড়তে না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। যদিও সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, তবুও এখন ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার। তবে আমি আশা করব, রোজায় কোনো পণ্যে যেন অতিরিক্ত মূল্যের কারণে ভোক্তাকে কষ্ট পেতে না হয়। সরকার যেন তার সব ব্যবস্থা করে।’
চিনি : যে আট পণ্য এবারের রোজায় ক্রেতাকে ভোগাবে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে চিনি নিয়ে। খোদ সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে গত এক বছরের ব্যবধানে দেশের বাজারে চিনির দাম বেড়েছে ৪৭ ভাগ। গত বছরের জানুয়ারিতে খুচরা বাজারে এক কেজি চিনির গড় মূল্য ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা। এখন বেড়ে হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। যদিও বাজারে এক কেজি চিনি এখন ১৩০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে চিনির আমদানি শুল্ক কমানোসহ সরকার অনেক পদক্ষেপ নিলেও কোনোভাবেই চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
সুতরাং রোজার মাসে চিনি ভোক্তাকে চরম ভোগাবে এবং চিনির কেজি ১৫০ টাকাও ঠেকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে ব্যবসায়ীদের। কারণ স্বাভাবিক মাসে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন, রোজায় বেড়ে সেটি হয় তিন লাখ টন। একদিকে চাহিদা দ্বিগুণ হয়, অন্যদিকে বাজার আগে থেকেই টালমাটাল।
এই অবস্থার মধ্যে চিনির এলসি খোলাও কম হচ্ছে গত বছরের তুলনায়। গত বুধবার সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্স কমিটির পঞ্চম সভায় জানানো হয়, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর- এই তিন মাসের চিনি আমদানির জন্য দেড় লাখ মেট্রিকটন কম এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ সবচেয়ে কমে গেছে। এই দুই মাস ও জানুয়ারি- এই তিন মাসের এলসি খোলা পণ্যই আসবে রোজার আগে। সুতরাং এবারের রোজায় চিনির সরবরাহ গত বারের চেয়ে কম থাকতে পারে।
ভোজ্য তেল : ভোজ্য তেল গত প্রায় তিনটি বছর ধরে ভোক্তাকে কষ্ট দিচ্ছে। দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের মূল্যে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র দুই বছর আগেও এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১০০-১০৫ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেলের কেজি ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের জানুয়ারিতেও এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৫০-১৬০ টাকা, এখন দাম ১৮৭-১৯০ টাকা। আসলে বাজারে এখন এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে দেশে ভোজ্য তেলের মাসিক চাহিদা ২ লাখ টন, রোজায় সেটি বেড়ে হয় ৪ লাখ টন। এই পরিস্থিতিতে এবার সয়াবিন আমদানির এলসি খোলাও কম হচ্ছে গত বছরের তুলনায়। গত বছরের তুলনায় ক্রুড সয়াবিনের আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ১ লাখ ৬৭ হাজার টন থেকে কমে এবার দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার মেট্রিকটনে। আর সয়াবিন সিড আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ২০২১ সালে ছিল ৪.৭১ লাখ টন, যা ২০২২-এ নেমে এসেছে মাত্র ৭৮ হাজার মেট্রিকটনে। সুতরাং এবারের রোজার বাজারে চাহিদার তুলনায় ভোজ্য তেলের সরবরাহ কম থাকবে, তাই দাম আরও বাড়তে পারে।
মসুর ডাল : রোজার মাসে সব ধরনের ডালের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। অন্য মাসে শুধু মসুর ডালের চাহিদা ৪০ হাজার টন থাকলেও রোজায় সেটি বেড়ে হয় ১ লাখ টন। চাহিদা যেমন বাড়ে দামও বেড়ে যায় অনেকখানি। গত এক বছরে বাজারে সব ধরনের ডালের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক। টিসিবির তথ্য বলছে, এক বছর আগে মাঝারি মানের এক কেজি মসুর ডালের কেজি ছিল ১০০ থেকে ১০৫ টাকা, এখন দাম বেড়ে হয়েছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা। তবে বাজারে এক কেজি ভালো মানের মসুর ডালের কেজি এখন ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। আসন্ন রোজায় দাম আরও বাড়তে পারে, কারণ সব ধরনের ডালেও এলসি খোলা এবার অনেক কম হচ্ছে।
ছোলা : স্বাভাবিক সময়ে ছোলার মাসিক চাহিদা ২০ হাজার টন হলেও রোজায় বেড়ে হয় ১ লাখ টন। সারা বছর ছোলা নিয়ে তেমন একটি খোঁজ-খবর না থাকলেও রোজার মাসে ছোলা নিয়ে এক রকম টানাহেঁচড়া শুরু হয়ে যায়। অন্যবার দেখা যায় রোজার মাসখানেক আগে ছোলার কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা থাকে, রোজার একেবারে আগ দিয়ে বেড়ে সেটি ৯০ থেকে ১০০ টাকায় ঠেকে। কিন্তু এবার এখনই বাজারে ছোলার কেজি ১০০ টাকার ওপরে। সুতরাং এবারের রোজায় সেটি ১২০ টাকা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাছাড়া চাহিদা বাড়লেও এবার ছোলারও এলসি খোলা কম হচ্ছে। ফলে রোজায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকবে বাজারে।
খেজুর : সারা বছর খেজুরের বিক্রি টুকটাক থাকলেও রোজার মাসে ছোলা বিক্রি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কারণ ইফতারিতে খেজুর ছাড়া চলেই না। অন্য মাসিক খেজুরের চাহিদা ৫ হাজার টন হলেও রোজায় সেটি বেড়ে হয় ৫০ হাজার টন। এবার খেজুর আমদানিরও এলসি কম হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। তাছাড়া ডলার সংকটের কারণে খেজুরসহ সব ধরনের বিদেশি ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। এ জন্য খেজুরের পাশাপাশি আপেল, কমলা ও আঙ্গুরসহ সব ধরনের ফলে দাম দ্বিগুণ বেড়ে গেছে আরও কয়েক মাস আগে থেকেই। ভালো মানের এক কেজি আজোয়া খেজুরের কেজি এক বছর আগেও যেখানে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ছিল, এখন তার দাম ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়া মাঝারি মানের এক কেজি খেজুরের দাম এক বছর আগে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা থাকলেও এখন দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। সুতরাং এবারের রোজায় খেজুরসহ সব ধরনের ফলের দাম অতীতের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা।
চাল ও আটা-ময়দা : দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের বাজার গত তিন বছর ধরেই লাগামছাড়া। ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমছে না। বছরে ৩ কোটি টন চালের চাহিদার হিসাব ধরলে মাসে লাগে ২৫ লাখ টন। রোজার মাসে চালের চাহিদার তেমন একটি হেরফের হয় না। তবে আগে থেকেই যেহেতু বাজার বেসামাল রোজায় চালের দাম আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বছরে ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। মাসে দরকার পড়ে ৫ লাখ ৮৩ হাজার টন। রোজার মাসে রুটি ও পরোটাসহ আটার তৈরি বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হওয়ায় এ মাসে আটা-ময়দার চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত এক বছরের মধ্যে আটা-ময়দার দাম দুই গুণ থেকে তিন গুণ বেড়েছে।
টিসিবির তথ্য বলছে, এক বছর আগে খোলা আটার কেজি ছিল ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা, এখন দাম রয়েছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। এক কেজি খোলা ময়দার দাম ছিল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা, এখন হয়েছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। আর রোজার আগে এই আটা-ময়দার দাম আরও এক দফা বাড়বে।
টিসিবির প্রস্তুতি প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য : রোজার মাসকে ঘিরে প্রতি বছর সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি বেশ কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে মাঠে নামে। এবারও সংস্থাটি ৫ পণ্য নিয়ে রমজানে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে টিসিবির প্রস্তুতি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। তারপরও পণ্য আমদানি ও মজুদের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান।
বৃহস্পতিবার তিনি জানান, এবারের রোজাকে ঘিরে টিসিবি মোট ৪ কোটি ৪০ লাখ লিটার সয়াবিন তেল মজুদ করছে। মসুরের ডাল মজুদ করছে ৪০ হাজার টন। এ ছাড়া ছোলা ১০ হাজার টন, চিনি ২৫ হাজার টন এবং খেজুর ১ হাজার ৩০০ টন মজুদ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এই পাঁচ পণ্য নিয়ে এবারের রমজানে মাঠে নামবে টিসিবি। এসব পণ্য আমদানির কার্যক্রম ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। কিছু পণ্য আমাদের গুদামে চলে এসেছে, কিছু পাইপলাইনে আছে আর কিছু পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে। আমরা আশা করি, রোজার আগে সব পণ্য পেয়ে যাবে। রোজার আগে ৫ মার্চ প্রথম দফায় এসব পণ্য দেশের ভোক্তার হাতে তুলে দেওয়া হবে, আর রোজা শুরুর পর দেওয়া হবে আরেক দফা।
Leave a Reply