নিজস্ব প্রতিবেদক // বরিশাল নগরীর নবগ্রাম রোডের বাসা থেকে মাদকসহ আটক হওয়ার পর তিন মাস জেল খাটেন বাবু নামের এক ব্যক্তি। পরে জামিনে বের হন।
পরে আদালত তাকে দুই বছরের সাজা দেন। কিন্তু প্রথমবারের মতো অপরাধ করায় তাকে প্রবেশনে দেওয়ার আবেদন করে বাবুর পরিবার।আদালত সব শুনে মায়ের সেবা করা ও বাড়ির আশপাশে গাছ লাগানোর শর্তে প্রবেশন মঞ্জুর করেন। তবে বিচারক সাফ জানিয়ে দেন, যদি এর ব্যত্যয় হয়, তাহলে ভোগ করতে হবে আগের দণ্ড।
বিচারকের নির্দেশে গত বছরের জুন থেকে বাবুকে বাসায় অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়। বাসায় তিনি তার মাকে ওষুধ খাইয়ে দেন, মা তিন বেলা ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না, তা দেখাশোনা করেন।
একই সঙ্গে বাড়ি-সংলগ্ন এলাকায় গাছও লাগিয়েছেন। বাবু আদালতের নির্দেশ কোনোভাবে উপেক্ষা করছেন কি না, তা তদারকিতে রয়েছেন প্রবেশন কর্মকর্তা।
বাবুর ৬০ বছর বয়সী মা জানান, তার ছেলেকে বিচারক দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। বিষয়টি প্রতিবেশী ও স্বজনরা জানলে লজ্জায় পড়তেন।
তাই প্রথমবার অপরাধ করায় তার জন্য প্রবেশন চাওয়া হয়। এতে বিচারক যেসব নির্দেশ দিয়েছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন বাবু। বিশেষ করে তাকে সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো।
কারণ তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। প্রতিদিন দুবার ইনসুলিন নিতে হয়। এর সঙ্গে চলে ওষুধ। সবকিছু বাবুই খেয়াল রাখছেন। এমনকি বাড়ির আঙিনায় গাছও লাগিয়েছেন বাবু। এদিকে প্রবেশন কর্মকর্তাও রাখছেন খোঁজখবর।
বরিশালে এভাবে বাসায় থেকেই জেল খাটছেন প্রথমবারের মতো অপরাধ করা দুই শতাধিক ব্যক্তি। শুধু দুটি ভালো কাজ তাদের অপরাধ থেকে মুক্তি দিচ্ছে।
এতে পেশাদার অপরাধীদের সঙ্গে মেশার সুযোগ না থাকায় তারা তাদের কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত হয়ে নতুনভাবে জীবন গড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
আর তা সম্ভব হয়েছে প্রবেশন আইনের কারণেই। এতে সমাজে সুফল আসছে বলে জানালেন সংশ্লিষ্টরা। ভাড়া বাসার সামনে লালশাক লাগিয়েছেন প্রবেশন পাওয়া মহিউদ্দিনভাড়া বাসার সামনে লালশাক লাগিয়েছেন প্রবেশন পাওয়া মহিউদ্দিন
নগরীর ফিশারি রোডের ভাড়াটে বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন গাঁজাসহ আটক হওয়ার পর কিছুদিন জেল খাটেন। এরপর বিচারক তাকে দুই বছরের সাজা দেন। সাজা শুনেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কারণ তার পরিবারে ক্যানসারে আক্রান্ত বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। আয় করার মতো কেউ নেই। এরপর তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রবেশনের আবেদন করা হলে তাকে ভালো কাজের শর্তে এক বছরের প্রবেশন দেওয়া হয়।
তাকে বিচারক শর্ত দেন যে পরিবারের সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে এবং গাছ লাগাতে হবে। প্রবেশনে এসে মহিউদ্দিন ভাড়া বাসার সামনের জায়গায় লালশাক লাগিয়েছেন। একই সঙ্গে বাবা ও পরিবারকে দেখভাল করছেন।
মো. মহিউদ্দিন বলেন, প্রবেশনে না দিলে তার বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যেতেন। তার স্ত্রী-সন্তানরা না খেয়ে থাকত। প্রবেশনে আসার পরপরই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন।
সেখান থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। সেই আয় দিয়ে ভালো আছেন তিনি। এর সঙ্গে বিচারকের দেওয়া নির্দেশ মোতাবেক ভালো কাজও করছেন বলে জানান তিনি।
মেহেন্দীগঞ্জের সাবেক ইউপি সদস্য মো. শাহজাহানের একটি মারামারির মামলায় জেল হয়। প্রবেশনের আবেদন করলে তাকে এলাকার মসজিদ ঝাড়ু দেওয়া ও ভিক্ষুকদের সাহায্যসহ একাধিক ভালো কাজের শর্ত দেওয়া হয়। তিনি এখন তা পালন করে যাচ্ছেন প্রবেশন কর্মকর্তার অধীনে।
অসহায়কে সাহায্য করছেন প্রবেশন পাওয়া সাবেক ইউপি সদস্য মো. শাহজাহানঅসহায়কে সাহায্য করছেন প্রবেশন পাওয়া সাবেক ইউপি সদস্য মো. শাহজাহান
বরিশাল আদালত থেকে বিভিন্ন মামলার সাজাপ্রাপ্ত এমন দুই শতাধিক আসামিকে প্রবেশনে দেওয়া হয়। যাদের মধ্যে ৬৫ জন আদালতের শর্ত পূরণ করে প্রবেশন থেকে মুক্তিও পেয়েছেন।
প্যানেল আইনজীবী আনোয়ার হোসেন মিজান বলেন, প্রবেশনে দেওয়ার সফলতা মিলেছে। প্রত্যেক অপরাধী তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন।
তারা আর কোনও অপরাধে জড়িত হচ্ছেন না। এমনকি পরিবারের সঙ্গে তাদের এখন আরও ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠছে। অনেকে এখন চাকরিও করছেন।
কেউ আবার জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। ১৯৬৪ সালের ৫ ধারায় আদালত এ প্রবেশন মঞ্জুর করেন বলে জানান তিনি।
বরিশাল সমাজসেবা অধিদফতরের জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, প্রবেশন প্রথমবারের মতো অপরাধ এবং লঘু অপরাধীদের সংশোধনে দেওয়া হয়।
এতে কারাগারের চার দেয়ালে থাকা পেশাদারি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে না থেকে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেই ভালো হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
একই সঙ্গে ওই অপরাধী ব্যক্তি যদি একটি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হয়ে থাকে, তাহলে পরিবারের সদস্যদের অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। এ থেকেও পরিবারটির মুক্তি মেলে।
এসব কারণে আদালত থেকে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ভালো কাজের শর্তে প্রবেশনে দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ভালো কাজে মনোনিবেশ করেছে।
তা ছাড়া কিছু পরিবারের সন্তান জেলে রয়েছে, এতে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার বিষয় জড়িয়ে থাকে। তা থেকেও রক্ষা মিলছে।
তিনি আরও বলেন, অপরাধীদের তার কৃতকর্মের জন্য যে কয়েক বছর সাজা দেওয়া হয়, প্রবেশনে ওই সাজা অনেক কমিয়ে আনা হয়।
ওই সময় পর্যন্ত অপরাধীদের প্রবেশন কর্মকর্তার অধীনে থাকতে হয়। এর মধ্যে পরিবারের কোনও সদস্য যদি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়, তবে তাকে আগের সাজা ভোগ করতে হবে।
জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রবেশনে থাকা অপরাধীদের নিয়ে মাদককে না বলা এবং অপরাধে জড়িয়ে না পড়া উদ্বুদ্ধকরণ সভা থেকে শুরু করে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা হয়।
এ জন্য সেমিনার কক্ষ রয়েছে। সেখানে তাদের এনে ওই সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। আর প্রবেশন শেষ করার পরও তাদের ফলোআপে রাখা হয়।
Leave a Reply