আজ শনিবার আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। একইসঙ্গে দেশে এটি পালিত হচ্ছে প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে। এ বছর এই দিবসটি হবে আন্তর্জাতিকভাবে ৩১তম ও জাতীয়ভাবে ২৪তম।
সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী অন্তত একটি প্রতিবন্ধিতা রয়েছে এমন ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে ধরা হয়।
‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ, প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা।’ এটাই হলো আজকের দিবসের প্রতিপাদ্য।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তির সংখ্যা ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮১ জন। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ৩ লাখ ৬৪৯ জন। বিবিএসের জরিপের তথ্য মতে, দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যার শূন্য দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন। চলতে-ফিরতে, লেখাপড়াসহ সব কিছুতেই। বেসরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তাদের একটি বড় অংশই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আমাদের দেশে এসব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করছেন তারা কয়েকটি মাধ্যম ব্যবহার করছেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের আশার আলো শ্রবণবান্ধব পাঠ্য বই। এছাড়া রয়েছে ব্রেইল পদ্ধতি।
দেশে হাজার হাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে যাদের পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা। তাদের জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বান্ধব ডিজিটাল উপকরণ সামগ্রীর সমন্বয়ে তৈরি করা পাঠ্যবই যেন আশীর্বাদ। তাদেরই একজন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মোহাম্মদ শাকিল খান। এগারো বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশেষ করে সহজলভ্য অধ্যয়ন সামগ্রীর অভাবে তাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। শিক্ষা জীবনে মাধ্যমিক স্তরে তিনি কোন ডিজিটাল উপকরণ পাননি। তাই শাকিলকে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে নানান সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই শাকিল আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। শাকিল জানান, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন উপকরণ পাওয়া ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি অডিও ফরম্যাটে অর্থ্যাৎ শ্রবণবান্ধব পাঠ্যবই হাতে পান। পরে তিনি জানতে পারেন যে এগুলোকে ‘ডেইজি-স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটাল টকিং বুক’ বলা হয়।
ডিজিটাল কথা বলার বইগুলো হচ্ছে শ্রবণযোগ্য উপকরণ যা মূদ্রণ এবং শেখার অক্ষমতাসহ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অডিও সংস্করণে পাঠ্যক্রম সরবরাহ করে। শ্রবণযোগ্য তথ্য প্রয়োজন এমন সবার জন্যই ডিজিটাল কথা বলার বই এই ‘টকিং বুক’। এর মাধ্যমে পাঠকরা অডিও চালাতে পারে এবং একই সাথে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যসূচি দর্শন ও হাইলাইট করতে পারে। যা বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সহজ করেছে।
অন্যদিকে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল সুবিধা অনেক বাড়লেও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। ব্রেইল পদ্ধতির নানা উপকরণ আরও সহজলভ্য হলে তাদের জন্য শিক্ষাগ্রহণ আরও সুবিধার হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৭১ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ৩১ জন রয়েছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ভলান্টিয়ার শিক্ষার্থীরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিখন কাজে সাহায্য করে থাকেন। তাদের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ব্রেইল পদ্ধতিতেও কিছু সমস্যা আছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় ডিজিটাল পদ্ধতির কথা ভাবছে।
অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫। এর মধ্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩৪ জন। এখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এখনও কোনো কারিকুলাম তৈরি হয়নি। এমনকি তাদের শিক্ষার জন্য অপরিহার্য ব্রেইল পদ্ধতিও নেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। শিক্ষার্থীরা শ্রুতি লেখকের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় অংশ নেন।
সারা দেশে ব্রেইল পদ্ধতিতেই চলছে পড়াশোনা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা হাতের সাহায্য ছাড়া পড়তে পারবে না। তাই ছোটবেলা থেকেই তাদের ব্রেইল পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। একটা সময় পর্যন্ত ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সঠিক কারিকুলাম বা ব্রেইল সরঞ্জাম পান না তারা। শ্রুতি লেখকই পরে ভরসা হয়ে দাঁড়ায়।
২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির ৯ হাজার ১৯৬ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য সরকার ব্রেইল পদ্ধতির বই ছাপে।
এদিকে, এটুআই কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি দল ওপেন সোর্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য (ডিএআইএসওয়াই) স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই, ই-বুক এবং ডিজিটাল ব্রেইল বই তৈরি করেছে। এসব বই ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। ডিএআইএসওয়াই কনসোর্টিয়াম, অ্যাক্সেসিবল বুকস কনসোর্টিয়াম এবং ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) প্রযুক্তিগত এবং এটুআই তহবিল থেকে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে প্রকল্পটি।
এটি সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তককে ( গ্রেড ১ থেকে ১০) সাশ্রয়ী ডিএআইএসওয়াই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ফরম্যাটে রূপান্তরিত। যার মাধ্যমে ব্রেইল, টেক্সট, অডিও বুক বা ই-বুক তৈরি সহজ করে তুলেছে। মাল্টিমিডিয়া টকিং বইগুলোর বিকাশ, উদ্ভাবনী মডেল এবং অনুশীলনের সাথে ডিজিটাল প্রকাশনাগুলোর সহজলভ্যতা সম্প্রসারণের কারণে প্রকল্পটি খ্যাতি ও বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেছে।
এসব পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) পুরস্কার, ২০১৭; জিরো প্রজেক্টস অ্যাওয়ার্ড অন ইনক্লুসিভ এডুকেশন (২০১৬); লন্ডন বই মেলায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৫-এ অ্যাক্সেসিবল পাবলিশিং ইনিশিয়েটিভের জন্য অ্যাক্সেসিবল বুকস কনসোর্টিয়াম অ্যাওয়ার্ড।
তথ্য সোসাইটি ইনোভেশন ফান্ড (আইএসআইএফএশিয়া) পুরস্কার, ২০১৪ ছিল ডিজিটাল টকিং বুক প্রকল্পের জন্য প্রথম মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই তহবিল এবং প্রাপ্ত পুরষ্কার মূলত সমস্ত শিক্ষার সহজলভ্যতা তৈরিতে আরও প্রচেষ্টা এবং উন্নয়নকে আরও বেশি সুরক্ষিত করে তুলেছে।
এটুআই-এর প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, এটুআই প্রকল্পটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করতে নিয়মিত কাজ করছে।
এই ডিএআইএসওয়াই ডিজিটাল টকিং বই পড়ার জন্য স্বল্পমূল্যের ডিজিটাল ব্রেইল ডিসপ্লে এবং কম দামের ডিএআইএসওয়াই মাল্টিমিডিয়া বই স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার সমাজের ‘ধারণানির্ভর দায়বদ্ধতার’ পরিবর্তে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে চায়। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা গেলে, তা বাংলাদেশের মানবকেন্দ্রিক এবং টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে।
Leave a Reply