মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতে বঙ্গবন্ধু কারাবরণ করেছেন। কিন্তু তাকে পেয়েও হানাদার পাকবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থামেনি। উপরন্তু তারা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে হত্যার ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল। অতীতেও বারবার দেখা গেছে গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামান্যতম আপসেও রাজি নন। তিনি নিজের প্রাণের তোয়াক্কা করেননি। আর গণমানুষের দুর্বার আন্দোলনে প্রতিবারই মুক্ত হয়েছেন। ফলে তার মতো নেতার বন্দিজীবন বরাবর এক শক্তিশালী প্রেরণা, জানবাজি রেখে লড়াইয়ের প্রাণশক্তি, অঙ্গীকার ও সংগ্রামের প্রতীক তিনি, চেতনার শিখা অনির্বাণ। তার প্রমাণ মিলল একাত্তরেও, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতা, মুক্তি পেলেন প্রাণের নেতা। দেশ পেল একটি পতাকা, জাতি গাইল তার জাতীয় সংগীত। লাল-সবুজের দেশের এবার এগিয়ে চলায় আর কোনো বাধা থাকল না। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। এবার ঘরের শত্রু বিভীষণ পাকিস্তানি চর আর পরাজিত প্রতিক্রিয়ার রাজনীতির ষড়যন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচতে দিল না। সপরিবারে তাকে হত্যা করল। দেশের এগিয়ে চলাকে অনিশ্চিত করে ফেলল, বিভ্রান্তি ও দিশাহীনতার এক অন্ধকার সময় এলো। এই দুঃসময়ে রাজনীতির মঞ্চে এলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের কালো অধ্যায়ের যবনিকা টানতে কাজ শুরু করলেন। দুই দশক পরে দলকে ক্ষমতায় ফেরালেন, ইতিহাসের কলঙ্কমোচন ও বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎমুখী স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ শুরু করলেন। মাঝে আবারও অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়েছিল, পথচলা রুদ্ধ হয়েছিল। তবে ২০০৯ সালে জাতীয় নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর থেকে শক্ত হাতে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুদুহিতা জননেত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের কথা আজ সবাই স্বীকার করেন। বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে দেশ। আজ অবকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে, কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। বিদেশে রপ্তানি আয় ও অভিবাসী শ্রমজীবীদের রেমিট্যান্স আয় বহুগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ পৌঁছেছে রেকর্ড উচ্চতায়। মানুষের আয় আড়াই হাজার ডলার পেরিয়েছে এবং গড় আয়ু ৭২ বছরের ওপরে উঠেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, মর্যাদা বেড়েছে।
এই রকম একটি সাফল্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ উদযাপন করেছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আজ আমাদের তাকাতে হবে ভবিষ্যতের দিকে।
আজ বিশ্বায়নের যুগ, আজ বিশ্ব অতিমারীর কাল চলছে, আজ প্রযুক্তির হাত ধরে সারাবিশ্ব চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ক্রান্তিকালে রয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারায় থেকে বাংলাদেশও নিম্নমধ্যম থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে।
সামনে কয়েক বছরে দেশের অনেকগুলো মেগাপ্রকল্প শেষ হবে। তাতে মানুষ ও পণ্যের চলাচল সহজ ও ব্যাপক হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে, তাতে শিল্পায়ন ও নগরায়ণে গতি সঞ্চারিত হবে। এবার প্রধান প্রধান এজেন্ডা হবে দুর্নীতি ও বৈষম্যের অবসান ঘটানো, সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মজবুত করা, সুশাসন ও আইনের শাসন বাস্তবায়িত করা এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এর জন্য আমলাতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য কমাতে হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর আইন ও বিচারবহির্ভূত তৎপরতা বন্ধ করতে হবে, উৎপাদন ও বিনিয়োগকে সহজতর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। বড় কথা হলো ক্ষমতার প্রশ্রয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অবৈধ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উত্থান ঠেকাতে হবে। আমরা লক্ষ করছি, প্রত্যেকটি প্রকল্পের মেয়াদ এবং বাজেট বারবার বাড়ানো হচ্ছে। এটি দুর্নীতির একটি লক্ষণ হিসেবেই গণ্য হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতি বড় হলেও ব্যাংকিং খাত ও স্টক মার্কেটের ব্যবস্থাপনা দুর্বল থেকে যাচ্ছে। কৃষিতে বৈচিত্র্য ও উৎপাদন বাড়লেও মজুদ, সরবরাহ ও বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়নি এখনো। যার ফলে কৃষক উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। তা ছাড়া সার ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্যয় বাড়ছে। শিল্পায়ন আশানুরূপ গতিতে এগোচ্ছে না, বাড়ছে না দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ, হচ্ছে না বৈচিত্র্য ও বহুমুখীকরণ, বাড়ছে না রপ্তানি বাজার, ঘটছে না ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের বিকাশ। অর্থাৎ শিল্প খাতেরও ভিত্ এত শক্ত নয়। শিক্ষা খাতে প্রাথমিকে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিশুদের ভর্তি প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে, কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষার নিশ্চয়তা কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা উন্নত স্বাস্থ্যবান দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির কোনো রোডম্যাপ আমাদের সামনে নেই। অথচ আজকের দিনে বলা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ হতে পারে উন্নত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সেটা অবশ্যই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণেই হতে হবে। স্বাস্থ্যরক্ষা এখনো দুর্বল ও অপর্যাপ্ত। সুস্থ-সবল জাতিগঠনের পূর্বশর্ত একটি দক্ষ সক্ষম আধুনিক স্বাস্থ্য পরিসেবা কাঠামো যা আমাদের দেশে নেই। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দেওয়াও সম্ভব হয়নি। এভাবে হয়তো তালিকা বাড়ানো যাবে, তবে তার প্রয়োজন নেই।
আমরা আশা করব সরকার অগ্রাধিকার নিশ্চিত করবে এবার। অবকাঠামো পরিকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। মোটা দাগে অর্থনীতিতে সচ্ছলতার আভাস মিলছে। সেটা ভালো কথা। কিন্তু এবার চাই সর্বক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা। আর চাই সুশাসন এবং উন্নত, দক্ষ ও সুস্থ মানবসম্পদ তৈরির নিশ্চয়তা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
Leave a Reply